চাষির মঙ্গল তুলা চাষে, বস্ত্র শিল্প তুলার আঁশে
অসীম চন্দ্র শিকদার
আমরা জানি খাদ্যের পরই বস্ত্রের স্থান। আর সেই বস্ত্রের প্রধান উপাদান হলো তুলা। বঙ্গদেশে যদিও তুলা চাষের ঐতিহ্য অতি প্রাচীন। ব্রিটিশ আমলের পূর্ব পর্যন্ত এ দেশে কার্পাস তুলার চাষ ছিল প্রতিটি ঘরে ঘরে। বাড়িতে বাড়িতে চড়কার মাধ্যমে সুতা তৈরি করে কাপড় বোনার দৃশ্য ছিল সাধারণ। এক সময় এদেশে বিশ^বিখ্যাত মসলিন কাপড় তৈরি হতো এই তুলা দিয়েই। তবে তা ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তুলা উন্নয়ন বোর্ড গঠনের মাধ্যমে পুনরায় বাংলাদেশে তুলা চাষের সূচনা করেন। পাট চাষের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে নেওয়া ৩২৫ জন চাষিকে স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে নিয়ে আসেন এবং তাদের তুলা চাষের জন্য জমি বরাদ্দ দেন। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে আমেরিকা হতে ডেল্টাপাইন জাতের তুলা বীজ আমদানি করে নতুন করে তুলা চাষ শুরু করে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ সারা বিশ^জুড়েই একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল হলো তুলা। তাই তুলাকে সোনার সাথে তুলনা করা হচ্ছে। তুলার অন্য নাম তাই সাদা সোনা। তুলার গুরুত্ব উপলব্ধি করে তাই বিশ^ব্যাপী তুলা দিবস পালিত হচ্ছে। ৭ অক্টোবর ২০১৯ সালে সুইজাল্যান্ডের জেনেভায় প্রথম তুলা দিবস পালিত হয়।
তুলা চাষের উপর গুরুত্বারোপ : বর্তমানে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ওপর ভিত্তি করে অর্থনীতি দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে, আর বিপুল কর্মসংস্থানের উৎসও এখন এই পোশাক শিল্প। ২০০৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৪০ শতাংশ ও ভিয়েতনামে ২৮ শতাংশ সুতি কাপড়ের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। তথ্যে দেখা যায় বাংলাদেশের জিডিপির ১৩ শতাংশ আসে বস্ত্রখাত থেকে, যা উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। পোশাক খাতের প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে তুলা। তবে বস্ত্রশিল্পের চাহিদার তুলনায় দেশে তুলা উৎপাদনে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি পূরণে বাংলাদেশকে তুলা আমদানি করতে হচ্ছে, আর সেজন্য প্রতি বছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে।
বাংলাদেশের জলবায়ু তুলা চাষের জন্য উপযোগী। এ ছাড়া খাদ্য শস্য উৎপাদনে বিঘœ সৃষ্টি না করেও তুলা চাষ এলাকা বৃদ্ধি করা সম্ভব। এমনকি অনুর্বর জমিতেও তুলা চাষ করা যায়। তাই বাংলাদেশে তুলা উৎপাদন বৃদ্ধির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সম্প্রতিকালে হাইব্রিডসহ উচ্চফলনশীল জাতের তুলা চাষ শুরু হওয়ার ফলে তুলা উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। তুলার মূল্যও বর্তমানে আকর্ষণীয়। বর্তমানে উচ্চফলনশীল জাতের বিঘা প্রতি ফলন ১২ থেকে ১৫ মণ আর হাইব্রিড জাতের ফলন বিঘাপ্রতি ১৫ থেকে ২০ মণ। যার বাজার দর বর্তমানে মণপ্রতি (৪০ কেজি) ৩,৮০০.০০ টাকা হিসেবে ৪৫,৬০০.০০ টাকা থেকে ৫৭,০০০.০০ টাকা এবং ৫৭,০০.০০ টাকা থেকে ৭৬,০০০ টাকার মতো। সুতরাং যথেষ্ট লাভজনক বলাই যায়। এ ছাড়া তুলা চাষের পর আর একটি ফসল চাষ করা যায়-যেমন পাট, তিল, গ্রীষ্মকালীন মুগ, ভুট্টা, গম প্রভৃতি। আবার তুলা ফসলের সাথে সাথী ফসল হিসেবে বিভিন্ন শাকসবজির চাষও করা যায়।
তুলার চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে তুলার উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারের সহযোগিতায় তুলা উন্নয়ন বোর্ড নানামুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে যেমন-চাষ এলাকা বৃদ্ধি, তুলা গবেষণা কার্যক্রম জোরদারকরণ, উচ্চফলনশীল এবং হাইব্রিড জাতের তুলা চাষ প্রবর্তন, নতুন নতুন চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন, বালাই দমনের জন্য ফেরোমনট্র্যাপ ব্যবহার, সমন্বিত ফসল ব্যবস্থাপনা (ওঈগ) চালু, চাষিদের তুলাচষের উপর দক্ষতা বৃদ্ধি ও আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির উপর প্রশিক্ষণ দেয়া ইত্যাদি গ্রহণ করা হয়েছে তথা জোরদার করা হয়েছে। তাই আশা করা যায় দেশে তুলার উৎপাদন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে এবং বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের পাশাপাশি আমাদের পোশাক শিল্পও সমৃদ্ধ হবে।
আসন্ন তুলা মৌসুমে তুলাচাষি ভাইদের করণীয় : এ বছর ফাল্গুন-চৈত্র মাসে বৃষ্টি হওয়ায় কৃষকগণ সময় মতো পাট চাষ করতে সক্ষম হয়েছেন, এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের স্বল্পমেয়াদি সবজি চাষও অনেক কৃষক করেছেন। তাই পাট কাটার পর অথবা সবজি উৎপাদনের পর অনেক কৃষক এ বছর সময় মতো অর্থাৎ শ্রাবণ মাসের মধ্যে তুলা চাষ করতে পারবেন।
তুলা চাষের জমি নির্বাচন : তুলার ভালো ফলন পেতে হলে জমি নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তুলা গাছ দাঁড়ানো পানি সহ্য করতে পারে না। তাই তুলা চাষের জন্য উপযুক্ত জমি হবে-যে জমিতে বৃষ্টির পানি দাঁড়ায় না, বন্যার পানি উঠে না এবং ছায়ামুক্ত উত্তম নিষ্কাশিত জমি। মাটির প্রকৃতি হবে বেলে দো-আঁশ এবং দো-আঁশ প্রকৃতির; তবে এটেল দো-আঁশ এবং পলি যুক্ত এটেল দো-আঁশ মাটিতেও তুলা চাষ করা যায়। মাটির অম্লত্ব এবং ক্ষারত্বের মান হবে ৬-৭.৫ এর মধ্যে অর্থাৎ অতি অল্প বা অতি ক্ষার উভয় প্রকার মাটিতেই তুলা চাষ করা যায়। অম্ল বা লাল মাটিতে চুন প্রয়োগ করে মাটিকে নিরপেক্ষ করে নিতে হবে। তুলা যেহেতু গভীরমূলী ফসল, তাই জমি গভীরভাবে চাষ করে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। জৈবসার যুক্ত জমিতে তুলা ভালো হয়। তাই জমি তৈরির সময় বিঘা প্রতি ১ থেকে ১.৫ টন গোবর/কম্পোস্ট/ পোল্ট্রিলিটার ছিটিয়ে দিয়ে চাষ দিতে হবে। পোল্ট্রিলিটার খুবই শক্তিশালী জৈবসার এবং বর্তমানে এটি সহজপ্রাপ্য।
জাত নির্বাচন : এখন তুলা উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাত যেমন- সিবি-১৪, সিবি-১৫, সিবি-১৯ এবং একটি হাইব্রিড জাত। এছাড়া বেসরকারী পর্যায়ে ২টি সীড কোম্পানি কর্তৃক আমদানিকৃত হাইব্রিড জাত যেমন রূপালী-১, ডিএম-২ বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চাষাবাদ হচ্ছে। চাষি ভাইরা আপনাদের জমির উপযুক্ত যে কোন জাত নির্বাচন করে চাষ করতে পারেন। তবে আগাম চাষ করলে হাইব্রিড জাতের তুলা চাষ করাই ভাল। আগাম চাষ অর্থাৎ আষাঢ়ের ১৫ হতে ১৫ শ্রাবণের মধ্যে চাষ করলে উচ্চফলনশীল হাইব্রিড জাতের তুলার চাষ করা ভালো।
বপন পদ্ধতি : তুলা বীজ সাধারণত উত্তর দক্ষিণে লাইনে বপন করা হয়। লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ৯০ সেমি. (৩ ফুট) এবং বীজ হতে বীজের দূরত্ব ৪৫ সেমি. (১.৫ ফুট) সর্ব ক্ষেত্রে বজায় রেখে তুলা বীজ বপন করতে হয়। বিঘা প্রতি বীজের প্রয়োজন হবে হাইব্রিড জাতের ক্ষেত্রে ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম আর উচ্চফলনশীল জাতের ক্ষেত্রে ১ থেকে ১.৫ কেজি। লাইনে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে হাইব্রিড বীজ ২টি করে আর উচ্চফলনশীল বীজ ২/৩টি করে মাটির হাফ ইঞ্চি গভীরে বপন করতে হবে। পরে ১০/২০ দিনের মধ্যে প্রতি মাদায় একটি করে তুলা গাছ রেখে বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে তুলে ফেলতে হবে। আঁশযুক্ত বা ফাজি বীজ ২/৩ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরে মাটি বা ছাই দিয়ে ঘসে বপনের জন্য প্রস্তুত করে নিতে হবে। বীজ বাহিত রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনে বীজ শোধন করে বীজ বপন করা যেতে পারে। ভালো ফলন পেতে হলে বিঘা প্রতি তিন হাজার গাছ থাকা নিশ্চিত করতে হবে। তাই কোন কারণে কোন মাদায় গাছ নষ্ট হয়ে গেলে সেই মাদায় বীজ অথবা চারা দিয়ে ৭/৮ দিনের মধ্যে পূরণ করে দিতে হবে।
সার প্রয়োগের মাত্রা : বিঘা প্রতি টিএসপি ২৫ থেকে ৩০ কেজি, ইউরিয়া ২৫ থেকে ৩০ কেজি, এমওপি ৩০ থেকে ৩৩ কেজি, জিপসাম ১৪ থেকে ১৬ কেজি, বোরণ ২.৫ থেকে ৩ কেজি, জিংক ২.৫ থেকে ৩ কেজি এবং জৈবসার ১ থেকে ১.৫ টন। টিএসপি সার তিন বারে প্রয়োগ করলে ভালো হয়। গাছের বয়স ৪০ ও ৬০ দিনে টিএসপির পরিবর্তে ডিএপি পার্শ্ব প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। জমির উর্বরতার উপর নির্ভর করে ইউরিয়া সার কম বেশি করা যাবে। পোল্ট্রিলিটার ব্যবহার করলে অর্ধেক রাসায়নিক সার ব্যবহার করলেই চলে।
তুলা ফসলের পরিচর্যা : ভালো ফলন পেতে হলে তুলা ফসলের অন্তর্বর্তীকালীন সঠিক পরিচর্যা অবশ্যই করতে হবে। যেমন- সঠিক সময়ে সারের পার্শ¦ প্রয়োগ, সঠিক সময়ে পোকামাকড় এবং রোগজীবাণু দমন, ফলিয়ার স্প্রে এবং হরমোন স্প্রে করা, আগাছা দমন, অঙ্গ ছাঁটাই বা ডিটপিং ইত্যাদি। ফুল থেকে ফলে পরিণত হওয়ার সময় এবং ফল পরিপক্ব হওয়ার সময় জমিতে রসের অভাব হলে হালকা সেচ দিতে হবে। মনে রাখবেন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ, সুষম সার প্রয়োগ এবং সময় মতো বালাই দমন তুলার ভালো ফলন পাওয়ার পূর্বশর্ত। চাষিভাইদের সহযোগিতায় মাঠপর্যায়ে কটন ইউনিট অফিসার ও ফিল্ডম্যান সর্বদা চাষি ভাইদের পাশে রয়েছেন।
তুলা এমন একটি ফসল যার প্রতিটি অংশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ; যেমন-তুলা থেকে বস্ত্রখাতের প্রধান উপাদান সুতা ছাড়াও বীজ থেকে খৈল, খাবার তেল, ফাজ থেকে ডাক্তারি তুলা, গাছ থেকে জ¦ালানি, কাগজ, হার্ডবোর্ড প্রস্তুত করা যায়। এ ছাড়া অনুর্বর জমিতে কয়েক বার তুলা চাষ করলে জমি উর্বর হয়। তাই বলাই যায় ‘চাষির মঙ্গল তুলা চাষে, বস্ত্র শিল্প তুলার আঁশে’। বাংলাদেশের চাষিভাইদের প্রতি নিবেদন তুলা চাষ করে নিজেরা লাভবান হউন এবং বস্ত্র শিল্পের অগ্রগতিতে অবদান রাখুন।
লেখক : কটন ইউনিট অফিসার (অব:), তুলা উন্নয়ন বোর্ড, ১০৪/১ (বি-২), শেরেবাংলা রোড, রায়ের বাজার, জাফরাবাদ, মোহাম্মদপুর-১২০৭। মোবাইল : ০১৯২৩-৪১২২৫৬, ইমেইল : asim.cdb@gmail.com